বাংলাদেশে সায়েন্টিফিক জার্নালের সম্ভাবনা

মেডি ভয়েস

অনেক বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়েও আমাদের দেশ বিভিন্ন দিকে অনেকখানি এগিয়েছি। অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়েছি কিছুটা। কিন্তু সেই অর্থে আমাদের অবস্থা স্থবির রয়েছে বিজ্ঞান চর্চায়। সেই অর্থে কোন গবেষণাগার নেই, নেই উপযুক্ত তহবিল এবং বিজ্ঞান চর্চার পরিবেশ। অনেকগুলো ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটি সমগ্র দেশের বিবেচনায় অপ্রতুল। নানা নিয়মের বেড়াজালে দেশের বাইরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে করে কাজ করাও কষ্টসাধ্য।

এই সবকিছুর প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের দেশীয় জার্নাল বা গবেষণাপত্রে। শুধু বায়োমেডিকেল সায়েন্সে প্রায় ১৫০টির মতো জার্নাল রয়েছে দেশে, কিন্তু মাত্র একটি জার্নাল পাবমেড ইনডেক্সভুক্ত। সেই সবেধন নীলমণি জার্নালটিরও যা অবস্থা তা বলাই বাহুল্য। আধুনিক সাবমিশন সিস্টেম নেই; নেই স্বচ্ছ পিয়ার রিভিও সিস্টেম। আপনি যদি কোন আর্টিকেল পড়তেও চান (অনলাইন বা অফলাইন) সহজে খুঁজে পাবেন না। ফলশ্রুতিতে আমাদের আর্টিকেলগুলো সাইটেশন পাচ্ছে না। কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মূল্যবান গবেষণাগুলো। গবেষকরাও পাচ্ছে না তাদের কষ্টের মূল্যায়ন।

একজন ছোট গবেষক হিসেবে এই ব্যাপারটা আমাকে খুব ব্যথিত করে। তার চেয়েও বেশি ব্যথিত করে যখন দেখতে পাই এই ব্যাপারে নিতান্তই কম আগ্রহ রয়েছে বিজ্ঞানমনস্ক ও নীতিনির্ধারকদের। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই জার্নালগুলোর মানোউন্নয়নের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা কম রয়েছে আমাদের জার্নাল এডিটরদের বা দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে। কেউ আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।

আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান পাই রিসার্চ কনসালটেন্সি সেন্টার দেশের জার্নালগুলোর মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। কাজ করার সুবাদে অনেকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমার কাছে এই প্রচেষ্টা না থাকার কয়েকটি কারণ প্রতীয়মান হয়েছে।

সময়ের সল্পতা

এডিটর বা এডিটরিয়াল বোর্ডের মেম্বারদের সময়ের স্বল্পতা অন্যতম। স্বাভাবিকভাবেই আপনি যখন প্র্যাকটিস করবেন, আপনার পক্ষে জার্নাল পরিচালনা করার মত সময় কম থাকবে। যেহেতু জার্নাল এডিটরটা বিনা বেতনে কাজ করেন, তাই এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো অবস্থান কারোর নেই। ফলশ্রুতিতে যারা যতটুকু কাজ করছেন, তা বিজ্ঞানকে ভালবেসে করছেন। কিন্তু সে ভালবাসা দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান বা জার্নাল পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

দক্ষ সমালোচকের অভাব

যদিও সংখ্যা বিচারে অনেক জার্নাল রয়েছে কিন্তু আনুপাতিক হারে সেই জার্নালে ভালো পর্যালোচনা করার মতো সামালোচক নেই। যারাও আছেন তাদের অনেকেই অনলাইন পদ্ধতে অভ্যস্থ নন। যার ফলে অনেক সময়ক্ষেপণ হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে জার্নালগুলো প্রকাশিত হচ্ছে না। আবার অনেক যোগ্য সামালোচকও আছেন, কিন্তু যেহেতু জার্নালটি অত মানসম্মত নয়, তাই জার্নালে পর্যালোচনা করে সময় নষ্ট করতে চান না।

ফান্ডের অভাব

যদিও পর্যালোচনা প্রক্রিয়াটি অনেকটাই বিনামূল্যে পাওয়া যায়, কিন্তু অনলাইন সাবমিশন সিস্টেম বিনামূল্যে নয়। সাবমিশন সিস্টেম, প্লেজারিজম চেকার, পর্যালোচনা কার্যক্রম পরিচালনা এবং আর্টিকেল গ্রহণ পরে প্রডাকশন। সবমিলিয়ে একটা স্ট্যান্ডার্ড জার্নালের জন্য অনেক খরচ করতে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেমন খরচ পড়ে? আমাদের একটা হিসাব বলে, প্রতিবছর যদি ছাপা খরচ বাদ দেই একটি জার্নাল মেইন্টেন্সের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার ডলার খরচ হবে, যা বাংলা টাকায় প্রায় ৩২ লাখ টাকা। অনেকের কাছে টাকার অংকটি বেশি মনে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্যই এই এমাউন্ট একেবারেই কিছু না।

দক্ষ জনবল

ভালো মানের এডিটরিয়াল বোর্ড, রিভিওয়ার এবং ফান্ড থাকার পরও এক দল প্রশিক্ষিত লোকবল প্রয়োজন, যারা এই পুরো সিস্টেমকে চালু রাখতে পারে। চিন্তা করুন, কোন জার্নালে একটি আর্টিকেল জমা হলো, কিন্তু কে এটির ইনিশিয়াল চেকিং করবেন এবং লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বা এডিটরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন? এডিটর হয়তো সিদ্ধান্ত নিলেন এই আর্টিকেল রিভিওতে পাঠাবেন। কিন্তু কে এই আর্টিকেলের জন্য রিভিওয়ার খুঁজে বের করবেন? কে সঠিক সময়ে রিভিওয়ার হতে রিভিওটি নিয়ে এডিটর ও লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন? রিভিও’র শুরু ও শেষে কে এটির প্লেজারিজম চেক করবেন? কে এর ভাষা এডিট করবেন? কে ছোটখাট ব্যকারণিক ভুলগুলো ঠিক করবে? কে ওয়েবসাইট দেখাশোনা করবেন? শুধু ভলান্টিয়ার বেসিসে এই কাজগুলোর গুণগত মান ধরে রাখা অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন এই এডিটরিয়াল প্রসেস বোঝার মতো এক দল প্রশিক্ষিত ও মোটিভেটেড জনবল।

ফারসাইটেডনেস

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশাল খরচ (যদিও অনেকের কাছে এই খরচ একেবারেই নগণ্য) কেন করব? এর ফল কি হবে? এই জার্নাল পরিচালনা করা এবং সঠিকভাবে গড়ে তোলার মধ্যে অবশ্যই বিজ্ঞানের কল্যাণ রয়েছে এবং রয়েছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। কিন্তু এর বাহিরেও এই জার্নালকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করারও রয়েছে বিশাল সুযোগ রয়েছে। অনেকে হয়ত নাক সিটকাবেন জার্নাল নিয়েও ব্যবসা! আমি বলবো, আপনি বিশ্বের বড় বড় পাবলিকেশন হাউজগুলোর দিকে তাকান।

প্রতিবছর বিলিয়ন ডলালের বিজনেস করছে। একইসঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতেও অসামান্য অবদান রাখছে। আপনি মদ-ইয়াবা গাজা নিয়েও ব্যবসা করতে পারেন, পারেন এরকম পাবলিকেশন নিয়েও। চিন্তা করে দেখুন, কোন ব্যবসার ফলাফল কি হবে সে বিবেচনা আপনার। আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে এই ফারসাইটেডনেসের অভাব রয়েছে বলে মনে হয়েছে।

আরও ছোট ছোট অনেক কারণ রয়েছে। তবে মোটা দাগে এই কারণগুলোই মুখ্য বলে মনে হয়েছে। আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার পক্ষে বা আমাদের মতো ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব না। কিন্তু এই প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম এই জন্য যে, এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হোক। হতেও পারে আলোচনা-সমালোচনা এর মধ্য দিয়ে যে কোন সমাধান বের হয়ে আসবে। আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। দরকার শুধু একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিনিয়োগকারী, যিনি মানুষের কথা ভেবে, বিজ্ঞানের কথা ভেবে, দেশের কথা ভেবে এগিয়ে আসবেন।

ডা. মোহাম্মদ জাহিদ হাসান

নির্বাহী পরিচালক,
পাই গবেষণা ও পরামর্শ কেন্দ্র।
কে-৬১, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

By Published On: May 26th, 2021Categories: UncategorizedComments Off on বাংলাদেশে সায়েন্টিফিক জার্নালের সম্ভাবনা